সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি আরও ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া মামলার অভিযোগ থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যসহ সাতজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
সোমবার কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বিকাল সোয়া ৪টার দিকে এ রায় ঘোষণা করেন। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান।
রায়ে যাদের যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন-প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব এবং টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
এছাড়া বেকসুর খালাস পাওয়া সাতজন হলেন-বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ।
সোমবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে এসে আদালতের কার্যক্রম শুরু করেন বিচারক। ৩০০ পৃষ্ঠার রায় পাঠকালে মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরেন তিনি।
সাক্ষ্যপ্রমাণে কার কী অপরাধ, দাঁড়িয়ে সেসব তুলে ধরার পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধ অনুসারে সাজা ঘোষণায় প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
এমনটি জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম। এর আগে বেলা ২টার দিকে আদালতে হাজির করা হয় মামলায় অভিযুক্ত বিতর্কিত ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকতসহ ১৫ আসামিকে।
রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের চারপাশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আদালতের সরকারি কৌঁসুলি, বাদীপক্ষের আইনজীবী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীসহ বাদী ও বিবাদীদের স্বজন এবং সংশ্লিষ্টরা এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, বিচারকের রায় ঘোষণার পর এজলাস কক্ষে কেঁদে ওঠেন ১৫ আসামির সবাই।
কেউ মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনে কাঁদেন। কেউ যাবজ্জীবনের জন্য, বাকি সাতজন খালাস পাওয়ার আনন্দে কেঁদে ওঠেন।
পর্যবেক্ষণ : রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের সাক্ষ্যের বিবরণীতে জানা যায়, মেজর সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন ওসি প্রদীপ। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে গুলি করেন লিয়াকত। ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে সিনহার বুকের বাঁ পাশে লাথি মারেন।
এতে মৃত্যু হয় সিনহার। সিনহার হাতে পিস্তল আছে ভেবে লিয়াকত গুলি করার কথা স্বীকারও করেছেন।
সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলীর জবানবন্দির বরাতে এই পর্যবেক্ষণ দেন আদালত। একই সঙ্গে বরখাস্ত এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতের জবানবন্দির কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, লিয়াকত আগে থেকেই নন্দদুলালকে বলেন সিনহাকে বহনকারী সিলভার কালারের গাড়ি থামাতে হবে।
চেকপোস্টে সিনহার দুই হাত উঁচু ছিল। ওই সময় লিয়াকত গুলি করেন। ঘটনাস্থলে প্রদীপ আসার পর সিনহার উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক কষ্টের পরে তোরে পাইছি।’ এই বলেই বুকে লাথি মারেন। নন্দদুলাল বলেছেন, ওসি প্রদীপের ভয়ে জব্দতালিকা তৈরি করেছেন।
তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই তৈরি করেছেন জব্দতালিকা। রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা উঠে এসেছে। বিচারক রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বলেন, আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলার বিভিন্ন ইস্যু ও খুঁটিনাটি বিষয় খোঁজার চেষ্টা করেছি।
এতে এপিবিএনের তিন সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। এই তিনজনই প্রথমে সিনহার গাড়িটি আটকানোর পর ছেড়ে দেন। পরে পুলিশ পুনরায় গাড়িটি আটকাল এবং ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
রায়ের পর আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা রায়ে আংশিক সন্তুষ্ট। প্রত্যাশা অনুসারে বিচার পাইনি। যারা খালাস পেয়েছেন, তারাও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মতোই সমান অপরাধী হিসাবে গণ্য। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেলে চিন্তা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিনহা হত্যা মামলার বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফাও রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, প্রত্যাশা অনুসারে বিচার পাওয়া যায়নি। খালাস পাওয়া আসামিদেরও সাজা কাম্য।
মামলার বাদী ও নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মামলার দুই প্রধান আসামির ফাঁসির রায়ের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। কিন্তু সাতজনের খালাস নিয়ে রয়েছে কিছুটা অসন্তোষ। যে সাতজনকে খালাস দেওয়া হলো, এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, তাদেরও কিছুটা দায়বদ্ধতা ছিল।
সে ক্ষেত্রে হয়তো তাদের কিছু সাজা হতে পারত বলে আমার মনে হয়। তবে রায়ে নয়-রায় কার্যকর হলে তবেই সন্তুষ্টি মিলবে বলে উল্লেখ করেন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
অতিরিক্ত পিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন জিয়া বলেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম এত দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে।
এ মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার নজির নেই।
তেমনটি নজির নেই এত স্বল্প সময়ে চার্জ গঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের। মাত্র ৩৩ কার্যদিবসে আমরা এ মামলার সব বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে সক্ষম হয়েছি।
আমরা সিনহাকে পরিকল্পিত হত্যার বিষয়টি প্রমাণে সক্ষম হওয়ায় ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা গেছে। স্বল্প সময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিনহা হত্যা মামলার রায়ের আগেই সবকিছুর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সোমবার সকাল থেকেই পুরো আদালতপাড়ায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতপাড়ার চার পাশে ও পয়েন্টে পয়েন্টে অবস্থান নেন নিরাপত্তাকর্মী। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা বিভাগের লোকজন কয়েক স্তরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল-আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত। কক্সবাজারের র্যাব-১৫ মামলাটির তদন্তভার পায়।
ওই বছরের ৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এরপর ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসেন।
আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন : উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, রায় ঘোষণার আগে আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন করেছে তার হাতে হত্যার শিকার ও নির্যাতিত ভুক্তভোগীদের পরিবার।
সোমবার বেলা ১১টায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে ‘ওসি প্রদীপের ফাঁসি চাই’ সংবলিত ব্যানারে মানববন্ধন করেন এসব স্বজন।